
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
টানাটানির সংসার। পরিবারের অভাব ঘোচাতে ইট-পাথরের শহরে পাড়ি জমান দুই ভাই নজির হোসেন ও নুর আলম। মাত্র ছয় হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ নেন রশি তৈরির একটি কারখানায়। টানা ২০ বছর চাকরি করলেও অভাব যেন পিছু ছাড়ছে না তাদের। এ অবস্থায় গ্রামে ফিরে ধারদেনার টাকা নিজেরাই শুরু করেন রশি তৈরির কারখানা। বর্তমানে তাদের কারখানায় চারজন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। নজির হোসেন ও নুর আলমের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরে রাজবল্লভ গ্রামে। বাবা নুর মুহাম্মদ একজন মাদরাসা শিক্ষক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদরাসাশিক্ষক বাবার অভাবের সংসারে হাল ধরতে এসএসসি পাস করে ২০০৩ সালে মুন্সিগঞ্জের মুক্তাপুরে রশি তৈরির কারখানায় ছয় হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকের কাজ নেন নজির হোসেন। কিছুদিন পর ছোট ভাই নুর আলমও ওই কারখানায় মেকানিকের কাজ নেন। এভাবে দুই ভাই প্রায় ২০ বছর চাকরি করলেও সংসারের অভাব ঘোচাতে পারেননি। পরে চাকরি ছেড়ে দেন তারা। নিজেরাই বাবার সহযোগিতায় একটি এনজিও থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন রশি তৈরির কারখানা। নাম দিয়েছেন ‘নজির হোসেন দড়ি ঘর’। কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আধাপাকা টিনশেড ঘরের মেঝেতে ১৫টি মেশিন বসানো। মেশিনে বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে রশি। সেখানে দুজন নারী শ্রমিক ব্যস্ত রশি তৈরিতে। এ কাজের তদারকি করছেন নজির হোসেন নিজেই। সুতা থেকে বিভিন্ন রঙের পাতলা, চিকন, মাঝারি ও মোটা সাইজের রশি তৈরি হচ্ছে মেশিনে। তবে চাকরি ছেড়ে আসা স্বপ্নবাজ দুই ভাইয়ের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। প্রতি মাসে আয়ের বিপরীতে লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান তারা। অপর্যাপ্ত পুঁজি আর লোডশেডিংয়ের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না এই উদ্যেক্তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আলেপ উদ্দিন ও জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা সংসারের বিভিন্ন কাজে যেসব দড়ি (রশি) বাজার থেকে কিনে আনি, তা আমাদের গ্রামেই তৈরি হয়। এটা আনন্দের খবর। কারখানাটি বড় হলে এ গ্রামের অনেক মানুষ এখানে কাজ করে খেতে পারবে। কারখানার শ্রমিক লাকী বেগম ও রওশন আরা জানান, তারা ঘণ্টা ২৫ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এতে প্রতিদিন ২০০-২৫০ টাকা আয় হচ্ছে। কথা হয় নজির হোসেনের বাবা নুর মুহাম্মদের সঙ্গে। তিনি জানান, বড় ছেলে নজির হোসেন এসএসসি পাস করে ২০০৩ সালে ঢাকায় রশি তৈরির একটি কারখানায় চাকরি নেন। কিছুদিন পর ছোট ছেলে নুর আলমও সেখানে কাজ নেন। দুই ভাই সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করলেও সন্তুষ্ট ছিল না। পরে তারা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই বাড়িতে কারখানা গড়ে তোলেন। তাদের কারখানায় তৈরি রশি গ্রামাঞ্চলে গরু, ছাগল, ভেড়া বাঁধতে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ভ্যান, ট্রলি ও ট্রাকে মালামাল বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়। উদ্যোক্তা নুর আলম বলেন, ‘প্রথম দিকে চারটি মেশিন দিয়ে কাজ শুরু করি। পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে ১৫টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৬০ কেজি রশি উৎপাদন হচ্ছে যা তুলনামূলক অনেক কম। এর প্রধান কারণ মেশিনগুলো বিদ্যুৎচালিত। কিন্তু আমাদের এলাকায় নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না। দিনে কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। তাই উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
কারখানাটির পরিধি বাড়াতে সরকারি সহযোগিতা চাইলেন নুর আলমের ভাই নজির হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে কাঁচামাল আনতে খরচ বেশি পড়ে। এতে লাভ হয় না। কারখানাটি বড় করতে পারলে এ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। তবে এজন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। সরকারিভাবে সহযোগিতা করলে উৎপাদন বাড়িয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম বিসিকের উপব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ বলেন, উদ্যোক্তা দুই ভাই যোগাযোগ করলে তাদের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।