সঞ্চিতা সরকার খুবি প্রতিনিধি
একেকজনের কাছে একেক নাম, কারও কাছে ‘নীল বাস’, কারও কাছে ‘স্মৃতির বাহন’ কিংবা ‘বন্ধুত্বের গন্তব্য’। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( খুবি) শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের বাহনের বাইরেও এটি এক টুকরো অনুভূতি, একগুচ্ছ স্মৃতি। প্রতিটি সকালে যখন ক্যাম্পাসে ঢোকে সারি সারি নীল বাস, তখনই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আনন্দ, বন্ধন আর ভালোবাসায় রঙিন এক যাত্রার নামই যেন এই ‘নীল বাস’। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নেয় একটি বিশেষ নাম- ‘নীল বাস’। কারও মনে প্রশ্ন জাগে, কখনও কি সে-ও হবে এই বাসের যাত্রী? বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার স্বপ্নের সঙ্গে যেন জড়িয়ে থাকে এই নীল বাহনের স্বপ্নও। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি শুধু একটি পরিবহন নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম অভিযাত্রার অংশ। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয়, প্রথম দিনের উচ্ছ্বাস, নীল বাসের সামনে দাঁড়িয়ে একক কিংবা দলবদ্ধ ছবিতোলা, জানালার পাশে বসে বাতাস উপভোগ, সব মিলিয়ে শুরু হয় এক নতুন অভিজ্ঞতার যাত্রা।
অন্যদিকে, শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে এই বাস যেন বিদায়ের এক নীরব সঙ্গী। শহর থেকে ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে নীল বাস সাক্ষী থাকে কত গল্পের, হাসি-কান্নার, প্রেম-বিরহের। চার বছরের জমে থাকা স্মৃতির পাতাগুলো যেন প্রতিটি যাত্রায় একবার করে খুলে যায় এই নীল বাসের জানালার পাশেই। ব্যাবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিনের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী বিপ্লব কুমার মন্ডল বলেন, ‘প্রথম দিন যখন নীল বাসে উঠলাম, তখনই অনুভব করলাম আমি সত্যিই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হয়ে গেছি। প্রতিদিন সকাল-বিকেল এই বাসে উঠতে উঠতে আমি বুঝতেই পারিনি, কবে এটা আমার রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, কখনো বাসে জায়গা না পেলে তখনই আমি বুঝি, নীল বাসের একটা সিট কত বড় সুখ এনে দেয়। শ্রেণিক্ষের বিষয়, শিক্ষক-শিক্ষিকার কড়া শাসন, পরীক্ষা বা প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে আলোচনা সবকিছুই হয় এই বাসের মধ্যে। অনেকের ভালোবাসার গল্পও শুরু হয় নীল বাসের জানালার পাশে বসেই! প্রতিদিন সকাল-বিকেলে এর চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় হাজারো শিক্ষার্থীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, গল্প ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। হিউম্যান রিসোর্স ডিসিপ্লিনের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তুলি রহমান বলেন ‘নীল বাস মানে শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া নয়, এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসংখ্য স্মৃতির অংশ। কত অসংখ্য সকাল এই বাসে বসে ক্লাসের নোট পড়ে কেটেছে, কত বিকেল বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে মগ্ন হয়ে ফিরেছি। ক্যাম্পাসের শেষ দিনগুলোতে এসে বুঝতে পারছি, নীল বাসের প্রতিটা সফর আসলে আমার চার বছরের স্মৃতিগুলোকে একটার পর একটা গেঁথে দিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে খুবির পরিবহন পুলে ২০২৩ সালের ৫ই নভেম্বর যুক্ত করা হয় ৫২ সিটের একটি নতুন বাস। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বড় বাসের সংখ্যা ১৩ টি সহ মোট গাড়ির সংখ্যা ৩৭টি। বাস ড্রাইভার শ্রী কিশোর কুমার বিশ্বাস এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাইভিং পোষ্টো আমি ১৯৯৮ সাল থেকে নিয়োজিত আছি। এই নীল বাসটা শুধু তোমাদের না, আমাদেরও অনেক স্মৃতির সাথী। তোমাদের আস্তে আস্তে বড় হতে দেখেছি। তোমাদের প্রতিটা যাত্রা যেন নিরাপদ হয়, সেই ভাবনাটা মাথায় নিয়ে দিন শুরু করি। কখনো ক্লান্ত লাগলেও, মনে হয় এই ছেলেমেয়েগুলোর জীবন আমার হাতে, একটা ভুল মানে বড় ক্ষতি। তাই দায়িত্বটা আমার কাছে শুধু চাকরি না, এটা একটা বিশ্বাস, একটা দায়িত্ব যার মানে অনেক বড়।