মো:রমিজ আলী, সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি(চট্টগ্রাম)
আমদানি করা পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ প্রথমে চুল্লির ওপর প্রি-হিটিং চেম্বারে দেওয়া হয়। চুল্লির ভেতরে সেই স্ক্র্যাপ গলানো হচ্ছে ১৬০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইম, ডমোলাইট, নাইট্রোজেন, কার্বন ও অক্সিজেন দিয়ে স্ক্র্যাপ পরিশোধন চলছে। এতে নির্দিষ্ট সময় পরপর চুল্লির ওপর অপদ্রব্য জমা হয়। আর নিচে জমা হয় বিশুদ্ধ তরল ইস্পাত। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুল্লি ৪ ডিগ্রি কাত হয়ে সেসব অপদ্রব্য ফেলে দেওয়া হয়।
এদিকে চুল্লির ওপর প্রি-হিটিং চেম্বারে থাকা স্ক্র্যাপ ততক্ষণে ৬০০ ডিগ্রি উত্তপ্ত হয়েছে। ফলে চুল্লিতে আগের চেয়ে কম সময়ে কাঁচামাল গলানো সম্ভব। প্রাথমিক পরিশোধনের পর আবার ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেসে (এলআরএফ) দ্রুততার সঙ্গে ডি-সালফারাইজেশন করার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রেড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় উপাদান যুক্ত করা হয়। তারপরই কন্টিনিয়াস কাস্টিং মেশিনে (সিসিএম) বিলেট উৎপাদন করা হয়। আর উত্তপ্ত বিলেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারখানায় অন্য পথ পাড়ি দিয়ে রোলিং এর মাধ্যমে রড আকারে বেরিয়ে আসে। যা অন্য কোনো কারখানায় দেখা যায় না।
এটি বলা হচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের সুলতানা মন্দির অবস্তিত জিপিএইচ ইস্পাত।জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে এভাবেই রড তৈরি করা হয়। এশিয়ার মধ্যে এই সর্ব প্রথম ও বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় হিসেবে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এমন প্রযুক্তি নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম। বর্তমানে এই প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ৬০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড জিপিএইচ কোয়ান্টাম ব্র্যান্ডে বাজারজাত করছে জিপিএইচ ইস্পাত। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালসহ বিভিন্ন প্রকল্পে জিপিএইচ ইস্পাতের রড ব্যবহৃত হয়েছে।
কারখানাটির উৎপাদনপ্রক্রিয়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মেল্টিং সেকশনে সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে বিলেট উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার, সৌরবিদ্যুৎ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উৎপাদনে ব্যবহার, পানি ও বায়ু পরিশোধনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে কারখানাটিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।যেইটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় না। কোয়ালিটির প্রকৌশলী জানান, বাংলাদেশে জিপিএইচ ইস্পাত প্রথম উচ্চশক্তির ৬০০ গ্রেড রড উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। জিপিএইচ কোয়ান্টামের ৬০০ গ্রেডের রডের লোডিং সক্ষমতা বেশি। এতে ৬০০ গ্রেডের রড ব্যবহার করলে ৫০০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ এবং ৪২০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রড সাশ্রয় হয়। আর যখন রডের ব্যবহার কমে, তখন কলামের সেকশন সাইজ কমিয়ে ভবনের নকশা করলে বেশি জায়গা পাওয়া যায়। ফলে সার্বিকভাবে নির্মাণ খরচ কমে।
সীতাকুণ্ডের উপজেলার সুলতানা মন্দির এলাকায় ১৫০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা কারখানায় জিপিএইচ ইস্পাতের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ১০ লাখ টন। জিপিএইচের কারখানায় উৎপাদিত ইস্পাত চীনেও রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানায়, দেশে ইস্পাত খাতে স্বয়ংক্রিয় কারখানা প্রায় ৪০টি। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪-৫টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে ১ কোটি টনের বেশি রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। দেশে রডের বার্ষিক ব্যবহার ৬৫-৭৫ লাখ টন।
পরিবেশবান্ধব উৎপাদনব্যবস্থা মেল্টিং সেকশনে কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে উৎপাদন চলছে। দৈত্যকার সেই চুল্লির বেশ কয়েক ফুট দূর দিয়ে যাওয়ার সময় আগুনের উত্তাপ এসে লাগল। তারপর ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেস পেরিয়ে আমরা কনটিনিয়াস কাস্টিং মেশিনে বিলেট উৎপাদনের কাছাকাছি চলে এলাম। রেললাইনের ওপর দিয়ে যেভাবে রেলগাড়ি চলে, ঠিক সেভাবে একের পর এক বিলেট যাচ্ছে। উৎপাদিত বিলেট সরাসরি রোলিং মিলে পাঠানো হয়। বিলেট উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় কিছু তাপমাত্রা হারায়। তখন রি হিটিং ফার্নেস বা ইন্ডাকশন হিটারে উত্তপ্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোলিং মেশিনে রোলিং করা শুরু হয়। একের পর এক মেশিনের ভেতরে রোল হয়ে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট আকৃতির রড আকারে বের হয়। সেই রড কুলিং বেডে শীতল করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধাই করা হয়। তারপর চুম্বকযুক্ত বিশাল ক্রেন দিয়ে ট্রাকে তোলা হয়। কারখানাটিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কার্বন নিঃসরণ খুবই কম। সে জন্য কারখানার ভেতরে একবারের জন্যও অস্বস্তি হয়নি।
রড উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। আর সীতাকুণ্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুবই নিচে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পাশের পাহাড়ি এলাকায় বিশাল আধার বা ড্যাম গড়ে তুলেছে জিপিএইচ ইস্পাত। সেখানে ১৫ লাখ ঘনমিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর নির্গত পানি পরিশোধন করে আবারও ব্যবহার করা হয়। এতে ৯০ শতাংশ পানিই আবার ব্যবহার করা হচ্ছে। জিপিএইচ ইস্পাতে ঘণ্টায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এর বড় অংশ জাতীয় গ্রিড থেকে নেওয়া হলেও কারখানার মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১২ মেগাওয়াট উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া ৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে জিপিএইচ রিনিউবল পাওয়ার প্ল্যান্ট। সেটি কিনে নেয় জিপিএইচ ইস্পাত। এ ছাড়া কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান সেই বিদ্যুতের দাম দিচ্ছে মাসে ২০ লাখ ডলার। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জিপিএইচের চুক্তি চার বছরের।
সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা:
রডের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। রডের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার লাগবে। এর মধ্যে ১৫ কোটি ডলার হংকং স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বাকি অর্থ কোম্পানির পুঞ্জীভূত মুনাফা বা রিটেইনড আর্নিংস থেকে জোগান দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা কত উৎপাদন সক্ষমতার নতুন কারখানা করব, সেটি এখনো চূড়ান্ত করিনি। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরই বিস্তারিত পরিকল্পনায় যাব।’
জিপিএইচ কোয়ান্টামের উচ্চশক্তির রড নিয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উচ্চশক্তির রড ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে পরিমাণগতভাবে রডের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা হবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি হবে আরও মজবুত।