নিজস্ব প্রতিবেদক।
ক্রিকেট অনেকেরই স্বপ্ন, আবেগ ও ভালোবাসা। আর বাঙালি মাত্রই আবেগপ্রবণ, স্বপ্নবাজ। ক্রিকেটের সফলতা স্বপ্নবাজ বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে নতুন পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশকে গর্বিত করেছে। এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। সকল বয়সীর সময় কাটানোর এক উত্তম মাধ্যম হল এই খেলা। ক্রিকেট আমাদের স্বপ্নকে আগামীর পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এক সময় অনেকের সন্তানরা বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও এখন অনেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে বড় হচ্ছে।
তারই মধ্যে অন্যতম একজন হলো লাকসাম উপজেলার আহাম্মদ উল্লাহ’র স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার দারুণ ভালোবাসা পোষণ করেন। গ্রামের মাঠে টেপ টেনিস বল দিয়ে শুরু হওয়া তার ক্রিকেট যাত্রায় আজ ইন্টারন্যাশনাল টিম পর্যন্ত পৌঁছেছে। গ্রামের মাঠে বিকেল হলেই ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়ত বন্ধুদের সঙ্গে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বল হাতে নিজের প্রতিভা প্রমাণ করেন তিনি। ক্রিকেট তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাকে শৃঙ্খলা, ধৈর্য এবং দলগত চেতনার মূল্য শিখিয়েছে। স্কুল জীবন থেকেই সে একজন ভালো বোলার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সকালে উঠে দৌড়, ফিটনেস আর বোলিং প্র্যাকটিস তার নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে এখন সে বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন দেখেছে।
কুমিল্লা জেলার লাকসাম পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের বিনয়ী গ্রামের সাবেক জনপ্রিয় মেম্বার মরহুম আলী নোয়াবের ছেলে আহাম্মদ উল্লাহ । পারিবারিক ভাবে সকলেই ক্রীড়াপ্রেমী, বাবা এক সময়ের ভালো ফুটবলার ছিলেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে আহাম্মদ উল্লাহ সবার ছোট। আহাম্মদ উল্লাহ ১৯৯৯ সালের ১ ফ্রেব্রুয়ারিতে জন্মগ্রহন করেন। শৈশব থেকে লাকসামের মাঠে, পাড়া-মহল্লায় ক্রিকেটের হাতেখড়ি দিয়ে পথচলা। আহাম্মদ উল্লাহ শিক্ষা জীবনে কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও অনার্স শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ক্রোয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। আহাম্মদ উল্লাহ শিক্ষা জীবনে ২০০৮ সালে কুমিল্লা মর্ডান স্কুলের ক্রিকেট টিম থেকে অনূর্ধ্ব ১২,১৪,১৬ ও ১৮ চট্টগ্রাম ডিভিশনে খেলে সুনাম অর্জন করেছেন।
আহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ক্রিকেট খেলার এজ লেভেল (age level) বা বয়স-শ্রেণী অনিয়ম একটি গুরুতর সমস্যা, যা বিশ্বজুড়ে খেলাটির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। এই অনিয়মগুলো সাধারণত বিভিন্ন স্তরে দেখা যায়, যেমন: স্থানীয় ক্লাব, স্কুল এবং জাতীয় পর্যায়ে। রীতিমত বয়স-শ্রেণী খেলার সময় খেলোয়াড়দের বয়স বা অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে করা হয় বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে দেখা যায় প্রকৃত প্রতিভাবান ও সঠিক বয়সের খেলোয়াড়রা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ক্রিকেট বোর্ড এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC) বয়স জালিয়াতি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের বিভাগীয় সহ জেলা পর্যায় বয়স যাচাইকরণ প্রক্রিয়া এবং ডকুমেন্টেশন যাচাই-বাছাই অপরিপূর্ণ। তাই মনে করি প্রতিভা সনাক্তকরণ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অব্যাহত সতর্কতা এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণ জরুরী । ফলে দলীয় পারফরম্যান্সে ভালো প্রভাব পড়বে।
এ সময়ে তিনি আরও বলেন তার ক্যারিয়ারে “মিস্ট্রি স্পিনার” দিয়ে শুরু হয় তার দীর্ঘ পথচলা, সে ২০২০ ও ২০২১ সালে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি ক্রোয়েশিয়ার “জাগ্রেব সকল ক্লাব” ক্রিকেট টীম এর হয়ে খেলে। তখন ক্রোয়েশিয়ার ক্রিকেট দলের নিয়মিত জনপ্রিয় ফাস্ট বোলার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। নিজের দল হিসেবে ক্রোয়েশিয়ার হয়ে ইউরোপীয় ক্রিকেট টিম এ খেলে নিজ দলকে জয় করেছেন একাধিক বার , নিজ দল ইউরোপীয় লীগের চ্যাম্পিয়ন সাথে লীগ সেরা বোলার হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেছেন। প্রত্যেক ম্যাচে নিজের বোলিং দিয়ে নৈপুণ্য ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি খেলেছেন স্পেনিশ লীগও। এরপর থেকে শুরু হয় তার পর্তুগাল মিশন। খেলেন ইউরোপিয়ান বড় টুর্নামেন্ট ক্রিকেট লীগ ইসিএল।
২০২২ সালে স্পেনের মালাগাতে, ২০২৩ সালে খেলেন স্পেনের বার্সেলোনার কয়টি ক্লাবে, ২০২৪ সালে নেদারল্যান্ডস এর পাঞ্জাব সিসিতে, খেলেন একাধিক বার ইউকে’র এমসিসি’র বিপক্ষে পর্তুগালের হয়ে। এছাড়াও গত চার বছর ধরে ইউরোপিয়ান লীগে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এখন সে পর্তুগালের জাতীয় টিমের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইতোমধ্যে ৩ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে ইউকে এর এমসিসি এর সাথে। তবে এখন সে মিশ্রি স্পিনার বোলিং হিসেবে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স দেখিয়ে জয় করে নিল সবগুলো ম্যাচ ই।পাশাপাশি অর্জন করেছেন একাধিক স্বর্ণপদক মেডেল, সেই সাথে ৩টি সিলভার মেডেল ,৩টি ব্রোঞ্জ মেডেল সহ অসংখ্য মেডেল। আহাম্মদ উল্লাহ সকল অংশগ্রহণ মূলক খেলায় “মিস্ট্রি স্পিনার” বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পাশাপাশি রয়েছে ব্যাটিংয়ের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স।
কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যাল -১ (পিপি) এর এডভোকেট বদিউল আলম সুজন বলেন, আহম্মদ উল্লাহ’র আজকের এই সফলতা শুধু লাকসাম নয় সে লাকসামের কৃতি সন্তান হিসেবে পুরো বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে, সে একজন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বর্তমানে সে পর্তুগালের জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে পারফর্ম করছে। আমি মনে করি সে বাংলাদেশেরই মুখ উজ্জ্বল করেছে। এইজ লেভেলের ক্ষেত্রে কোচ সহ প্যানেলকে আগামী প্রজন্মকে সিলেকশনে আরও নজরদারি করতে হবে যেনো যোগ্য ব্যাক্তিকে নির্বাচিত করা হয়। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলেন শুধু ইচ্ছে শক্তি থাকলেই হবে না, আপনার লক্ষ্য ঠিক থাকলেই আপনি সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন। তার জন্য প্রয়োজন ডিটারমাইন্ড এবং হার্ডওয়ার্ক।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের (বিসিবির) সাবেক ম্যানেজার বদরুল হুদা জেনু বলেন, যে খেলে সে তো বিচারক নয় এবং তার অভিভাবক ও বিচারক নয়, আইনগতবৃত্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্বাচন প্যানেল বানিয়ে দেয় তারাই নির্বাচক। দেখা যায় একটি টিম গঠন করার জন্য ১৫/২০ জনের লিস্ট করা হয়, সেখান থেকে কোচ বেস্ট ইলেভেন সিলেক্ট করা হয়। এই ইলেভেনে যারা টিকতে পারে তারা কখনোই বলে না যে পক্ষপাতিত্ব হয় কিন্তু যারা টিকতে পারে না তারা মনে করে যে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে। তবে এটা রিতীমত তার প্রতি অবিচার করা হয়, এইজন্য সে ওভারকাম করতে পারেনা, দেখা যায় তখনই তার মনস্তাত্ত্বিক ওপর চাপ পড়ে। আমি মনে করি প্রত্যেকটা জিনিসে আস্থা রাখতে হবে, তবে আমরা মানুষ হিসেবে যে নির্বাচকের ভুল হয় না তাও বলা যাবে না।
বড় ভাই শাহাজাহান হোসেন বাঘা বলেন, আমরা পারিবারিকভাবেই বরাবরই ক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত, আমার বাবা ও একজন ভালো ফুটবলার ছিলেন এবং আমরা আমাদের সময়তে জেলা পর্যায়ে খেলেও চ্যাম্পিয়ন অর্জন করেছি । তবে একটা সময় স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে জাতীয় দলে অংশগ্রহণ করার, কিন্তু সেটা সম্ভব না হলেও ধারাবাহিকতায় আমার ছোট ভাই তা ধরে রেখেছেন এবং সে পর্তুগালের জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে।
বড় ভাই মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ছোট ভাই দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন থাকলেও তা তৎকালীন বৈষম্যের কারণে তার স্বপ্ন পরিপূর্ণ হয় নাই, কিন্তু সে এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে পর্তুগালের জাতীয় দলে সম্পৃক্ত হয়ে দেশেরই মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার প্রতি পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা থাকবে সবসময়।