আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জোবেদা বেগমের দিন কাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে। অথচ সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার স্বামীর নামে ভাতা প্রদান করা হলেও সে সুবিধা ভোগ করতে পারেননি তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তার মৃত স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুল ইসলামের ভারতীয় তালিকা নাম্বার ব্যবহার করে একই নামধারী এক সরকারি চাকরিজীবী নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ভোগ করছেন।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগী ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ঠেলাগাড়ি চালক আ. জব্বার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাননি। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাতিয়া অনন্তপুরের মফিজুল ইসলাম ভারতের মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। তার ভারতীয় তালিকা নম্বর ৩৯৭০৩। ট্রেইনিং শেষে সম্ভবত মফিজুল ইসলাম ৬নং সেক্টরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পরপরই তাকে নীলফামারীতে দেখেছিলেন, তার সঙ্গে মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া যোদ্ধারা। এরপর তিনি আর নিজ বাড়িতে ফিরে আসেননি। পরিবারের ধারণা তিনি মারা গেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জোবেদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী যখন যুদ্ধে অংশ নিতে যান, তখন আমাদের একমাত্র সন্তান আব্দুল জব্বারে বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। দেশ স্বাধীন হলো, মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে এলো, শুধু ফিরে এলো না আমার স্বামী। এরপর দেখতে দেখতে ৫৫টা বছর পেরিয়ে গেল, তবুও আর স্বামী ফিরে এলো না। সে সময়ের ফেলা আসা কষ্টের দিনগুলোর কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এই বৃদ্ধা। বর্তমানে এ নারী জীবিকা নির্বাহ করছেন, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আব্দুল জব্বার বলেন, আমার বাবার ভারতীয় তালিকার ৩৯৭০৩ নং ব্যবহার করে নিয়মিত ভাতা উত্তোলন করছেন দলদলিয়া ইউনিয়নের কুটিরপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এমন খবর পেয়েছি আমার বাবার সঙ্গে ট্রেইনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে।
জানা যায়, ২০২৩ সালে আব্দুল জব্বার কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে তৎকালীন উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে তিনি সমাজ সেবা কর্মকর্তাকে তদন্তভার দেন। কিন্তু সমাজ সেবা কর্মকর্তা সেই সময় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দলদলিয়া ইউনিয়নের কুটিরপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন দেন। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আব্দুল জব্বার আরও বলেন, ঠেলাগাড়ি চালিয়ে খেয়ে না খেয়ে আমাকে বড় করেছে। আমার মা আজও অন্যের বাড়ি ভিক্ষা করে জীবন চালায়।
উলিপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, একই নাম ও বাবার নাম মিলে যাওয়ায় এবং দীর্ঘ সময় মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার কেউ না থাকার সুযোগ নিয়েছে উত্তর দলদলিয়া ইউনিয়নের কুটিপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি অবসরপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তারা আরও জানান, ভারতীয় তালিকার ঠিকানা অনুযায়ী অনন্তপুর হাতিয়া ইউনিয়নের মফিজুল ইসলাম কিংবা তার পরিবারের লোকজনই মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার হবে। অন্য ইউনিয়নের কেউ ভারতীয় তালিকার ওই নম্বর ব্যবহার করতে পারেন না। ভারতের মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৪ বীর মুক্তিযোদ্ধাও মফিজুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানের পক্ষে সংবাদকর্মীদের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন, মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল বাতেন সরকার (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮১), মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮২), মুক্তিযোদ্ধা মো. রবিউল ইসলাম (পরিচিতি নং ০১৪৯০০০১৭৯৯) ও মুক্তিযোদ্ধা শ্রী সুবল চন্দ্র রায় ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৪৭৯। সবারই বাড়ি উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নে। সাক্ষাৎকার দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, সঠিক তদন্ত হলেই আসল মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি জানা যাবে।
অভিযুক্ত মফিজুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করে বলেন, আমি ২০১০ সালে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ভোগ করে আসছি। ২০২৩ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দাবিদার জোবেদা বেগম নামে একজন আমাকে ভুয়া প্রমাণ করতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সমাজ সেবা কর্মকর্তার তদন্তে উত্তর দলদলিয়া এলাকায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আমি সঠিক মুক্তিযোদ্ধা বলে সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়েছেন। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমি দাখিলকৃত কাগজপত্র ও ভাতাভোগী মফিজুল ইসলামের সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছিলাম। আসলে জোবেদার পক্ষে কোনো ভালো লোক সাহায্য করেনি কিংবা সাক্ষ্য দেয়নি। আবারও পুনরায় তদন্ত হলে আর তদন্তের দায়িত্ব আমার দপ্তরে এলে আমি বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে দেখবে।
অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নয়ন কুমার সাহা বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করছি। উপরের নির্দেশনা পেলেই নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা হবে।